শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রসংগঃ মনকে নিয়ন্ত্রণ – মানসিক সমস্যা এবং কভিট ১৯

প্রকাশিত : ৭:১৯ অপরাহ্ন শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

 

নিজস্ব প্রতিবেদক, দেশবাংলা ডট নেটঃ

বৈশ্বিক এই মহামারী করোনা পৃথিবী থেকে যে সহজে চলে যাবে না, তা আমরা মোটামুটি সবাই আন্দাজ করতে পেরেছি। এবং এই করোনাকালীন সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই আমরা সবাই মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পরেছি। সবাই যে যার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে, পরিবার পরিজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতই বেশী চিন্তিত যে, কেউ কেউ এখন মানসিক রুগীতে পরিণত হয়ে পরেছেন। গত কয়েকদিন ধরে আমি প্রচুর পরিমানে মেসেজ ও কল পাচ্ছি রুগী ও রিলেটিভ থেকে তাদের সমস্যা নিয়ে, যা আমার কাছে তাদের মানসিক সমস্যা বলেই মনে হয়েছে বেশী।
তাই আজকে আমি আমার নিজের ক্ষুদ্র নলেজ এবং কিছু এ বিষয়ে ঘাটাঘাটি করে প্রাপ্ত নলেজ থেকে কিছু পরামর্শ আপনাদের দেয়ার চেস্টা করছি।

প্রথমেই আমি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটু ভুমিকা দিব।
মানসিক রোগের মধ্যে দু’টো ভাগ আছে। একটিকে আমরা বলি Psychosis এবং অন্যটিকে বলি Neurosis.
সাইকোসিস রুগীরা আসলে বিশ্বাস করতে চায় না যে তাদের মানসিক রোগ আছে, যার দরূন তারা চিকিৎসা দ্রুত নেয় না, ফলে সুস্থ হতে সময় নেয় বেশী।
নিউরোসিস রুগীরা নিজেরা বুঝে এবং জানে যে তারা মানসিক রুগী, ফলে চিকিৎসা নিয়ে তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।

করোনা একটি Chronic সমস্যা আমাদের জন্য। আগেই বলেছি এটির জন্য আমরা সবাই মানসিকভাবে দূর্বল এবং ভেংগে পরেছি। এই দূর্বল হতে হতে এবং টেনশন করতে করতে এক সময় আমরা সাইকোসিস রুগীতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের ভিতরে যে সাইকোসিস ডেভেলপ করছে তা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছি না। পরিশেষে আমরা Delusion, Hallucination এমন কি Schizophrenia এর পেসেন্ট হয়ে যেতে পারি।

তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে আমাদের কিছু একটা করা লাগবে, যাতে আমরা এই মহামারীর টেনশন করে Anxity & depression এ ভুগে নিজেদের মানসিক রুগী যাতে না বানাতে পারি।
আরেকটি কথা বলে রাখি, আমরা কিন্তু এখনও সবাই Anxity তে আছি মানে ভুগছি। আর এই সময়টা আসল সময় কিছু করার, নিজেকে বাঁচানোর। একবার Depression এ পরে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে সুস্থ হওয়ার।

নীচে আমি এই করোনাকালীন সময়ে এবং বাসায় যারা লক ডাউন অবস্থায় রয়েছেন তাদের জন্য কিছু পরামর্শ দেয়ার চেস্টা করব। হয়ত কিছুটা উপকার পেতে পারেন।

সর্বপ্রথম আগে আপনাকে প্রতিংগা করতে হবে নিজের কাছে, পরিবারের কাছে, নিজের শরীরের কাছে; যে আপনি কিছু করতে চান। আরেকটু সুন্দর করে বললে…

Tell yourself, your family & your body (via your mind) that you are doing something. ??

তারপর আপনি দৈনিক কার্যক্রমের একটি রুটিন তৈরি করবেন। নীচের আলোচনা থেকেই আপনি তা নিজেই নিজেরটা তৈরি করতে পারবেন।

★ আপনাকে আপনার মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সারাদিন আপনি মোবাইলে ফেইসবুক বা অন্যান্য সোসাল মিডিয়া চালাতে পারবেন না।
★ নিউজ চ্যানেল এর ক্ষেত্রেও একই পরামর্শ, আপনি সারাদিন নিউজ চ্যানেল দেখতে পারবেন না।

কি কি করতে পারবেন না, তার মধ্যে উপরের উল্লেখিত এই দুটিই মেইন। কারণ আমরা সকলেই জানি। এই দুটি মাধ্যমই আমাদের সবচেয়ে বেশী দূঃসংবাদ গুলো বর্তমানে দিচ্ছে। সুতরাং আপনাকে প্রথমেই টেনশনের এন্ট্রি পয়েন্ট বন্ধ করতে হবে।
তার মানে কি আপনি দেশের কোন খবরাখবর নিবেন না? না, তা বলি নি। অবশ্যই আপনি আপডেট খবর নিবেন তা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে।
উদাহরণ সরূপ আপনি সেই খবর সকাল ১০-১১ টার দিকে এবং বিকাল ৫-৬ টার দিকে নিতে পারেন সারাদিন ২ বার। এর বেশী নয়।
সবচেয়ে দরকারী পয়েন্ট হলো আপনি সন্ধ্যা ৬-৭ টার পর মোবাইল বা টিভিতে কোন নিউজ দেখবেন না। ঘুমাতে যাওয়ার ২-৩ ঘন্টা আগে কোন অবস্থাতেই সোসাল মিডিয়া এবং নিউজ চ্যানেল দেখবেন না।

★এবার আসুন আমরা এই ফ্রী সময়ে কি কি করতে পারি মোবাইল – টিভি থেকে দূরে থাকার জন্য।

— নিজের মনকে পরিবর্তন করতে হবে, যেহেতু আমরা নতুন কিছু, নতুন নিয়মে, বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে।
— যারা রান্নাবান্নাতে আগ্রহী তারা দিনের একটি বেলায় তা করতে পারেন, নিজের প্রতিভাকে জাগ্রত করতে পারেন। নতুন নতুন খাবারের ডিশ তৈরী করে পরিবারকে খাওয়াতে পারেন।
— যাদের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তারা তা করতে পারেন।
— যাদের ছবি বা ফটোগ্রাফিতে শখ, তারা এই সময়টিতে পুরনো ফটো গুলো এডিটিং করতে পারেন।
— যাদের ছাদ আছে বা সামনে উঠান আছে, তারা বাগান করতে পারেন। যাদের বাগান অলরেডি আছে তারা তা পরিচর্যা করতে পারেন।
— পুরনো দিনের এলবাম বের করে পরিবারের সবাই মিলে তা দেখতে পারেন। স্মৃতি রোমন্থন করা, শেয়ার করতে পারেন পরিবারের সদস্যদের সাথে।
— ইনডোর প্রচুর গেইমস আমরা খেলি, যেমন ঃ দাবা, লুডু, ক্যারাম, তাস ইত্যাদি। আমরা পরিবারের সদস্যদের সাথে তা খেলতে পারি।
— যাদের ব্যায়াম করার শখ, তারা তাও করতে পারেন একটি বেলায়। এবং এটি সবার জন্যই জরুরী।
— দিনে তিনবেলা করে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস এর ব্যায়াম করতে পারি। Breathing exercise বলি আমরা। কিভাবে করে তা ইউটিউব এ পাবেন।
— সর্বশেষ যেটা বলব তা হলো গুরুত্বপূর্ণ নামাজ বা ইবাদত করা। আমরা যে যার যার ধর্ম মতে বেশী বেশী ইবাদত করব এবং আল্লাহর কাছে পানা চাইব।

^>^>^> আসলে উপরে উল্লেখিত পরামর্শ গুলো আমরা সবাই জানি এবং অলরেডী অনেকে পালন করছিও। তবুও বললাম যারা এখনও শুরুই করেননি তাদের জন্য। যারা এখনও দিনের ৮০% সময় টেনশন করেই কাটাচ্ছেন তাদের জন্য।

এবার আমি চেষ্টা করছি নতুন কিছু বলার জন্য, আমার কাছেও অনেক পয়েন্ট নতুন মনে হয়েছিল, আপনাদেরও তা মনে হতে পারে।

★সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুম যাওয়ার আগে দুইবার Relaxation exercise আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। এই Relaxation টা কেমনে করে সেটাই প্রশ্ন।
ইউটিউব বা গুগুল করলে Guided Relaxation লিখে অনেক অডিও ক্লিপ পাওয়া যাবে। তবে আমি একটু ধারণা দিচ্ছি।
প্রথমে বিছানায় শরীর লেটিয়ে দিবেন। তারপর একটি একটি করে শরীরের প্রতিটি অংগ শক্ত-টানটান করবেন, করতে থাকবেন, ছাড়বেন না। ধরুন হাতের ক্ষেত্রে আপনি বাম হাতকে শক্ত করলেন, ঔ শক্ত টান টান অবস্থায় থাকুন, অনেকক্ষণ থাকুন, আপনি আপনার হাতের মাংশপেশীগুলোকে ফিল করার চেষ্টা করুন, একসময় একটু একটু ব্যথা শুরু হবে, যতক্ষণ সহ্য করতে পারেন করতে থাকুন,,, তারপর ছেড়ে দেন, রিলাক্স করুন বাম হাতকে। চোখ বন্ধ করে ফিল করতে থাকুন হাতের Relaxation. এভাবে শরীরের সকল মাংসপেশির relaxation exercise করতে থাকুন। সর্বশেষে পুরো শরীর একসাথে রিলাক্সজেশন ব্যায়ামটি করবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ২ বার। এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহুর্তে ২ বার করে করবেন।এতে আপনার শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

★ Karaoke : এটি আমাদের দেশে খুব একটা বেশী প্রচলন নাই। তবে কমবেশি অন্য স্টাইলে আমরা সবাই করে থাকি প্রতিটি ঘরে। পরিবারের সবাই মিলে গান চর্চা করা, গানের সাথে আনন্দ করা। যারা ধর্মীয় কারণে এটি করেন না তারা হাম নাত গজল তেলওয়াত চর্চা করতে পারেন। অথবা কৌতুক বলতে বা করতে পারেন।
তবে karaoke এর আসল উদ্দেশ্য হলো ফান, মজা করা। দিনের একটি সময় বিশেষ করে সন্ধায় ডিনার এর আগে বা পরে পরিবারের সবাই মিলে আনন্দ করতে হবে।

★ যাদের ছবি দেখার অভ্যাস, তারা কমেডি মুভি দেখতে পরামর্শ দিব। খুন খারাবি বা এমন কোন মুভি চয়েজ না করা যাতে আপনি বিষন্নতায় ভুগেন।

★ মিউজিক, ইয়োগা, মেডিটেশন এগুলোও বিকল্প হতে পারে দিনের কিছুটা সময় পার করার জন্য।

★ যাদের বাচ্চা আছে, তাদের এটাই সুযোগ বেশী করে সময় দেয়ার। তাদের সাথে রিলেশনশীপটা আরো ডেভেলপ করার।
বাচ্চাদের অবশ্যই করেনা নিয়ে ভীতি প্রদর্শন করবেন না, ভয় দেখাবেন না। তাদের বুঝাবেন, সতর্ক করবেন।

★ দুপুরে ১ ঘন্টার বেশী ঘুমানো উচিত হবে না। বেশী ঘুমালে রাতে ঘুমাতে দেরী হবে।

★ বাসায় যারা পড়াশোনা করছেন, বা অফিসের কাজ করছেন, অন্য যা কিছুই করছেন তা অবশ্যই ঘুমানোর বিছানায় করবেন না। অন্য জায়গায় করবেন। ঘুমানোর বিছানাটাকে শুধুমাত্র ঘুমানোর কাজেই ব্যবহার করবেন। অন্য কাজে ব্যবহার করলে পরে আর ঔ বিছানায় ঘুম আসবে না।

★ Social distancing নাকি Physical distancing… আমার একটু দ্বিমত আছে এই টার্ম টি নিয়ে।
আমি বুঝি এমন…
We should make physical distancing, shouldn’t social distancing, but we have to make more social reconnect & restrengthen. We must find ways to be socially together while physically apart…& to help other when possible.

আমাদের সমাজ থেকে আলাদ থাকা চলবে না। অন্যের শরীরের সাথে না লেগে, তার থেকে শারিরিক দূরত্ব বজায় রেখে একই সমাজে বাস করতে হবে। এক ঘরে হয়ে থাকলে, তা মানসিক কষ্ট এবং দূঃচিন্তা আরো অনেকগুন বাড়িয়ে দিবে।

তাই সমাজের মানুষের খবরাখবর নিতে হবে, তাদের প্রয়োজন অনুসারে তাদের সাহায্য করতে হবে। অন্যকে সাহায্য করা এমন একটি মহৎ কাজ যা আপনাকে প্রচুর প্রশান্তি দিবে, যা আপনি অন্য কোন ঔষধে পাবেন না।

পরিশেষে আবার বলতে চাই, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন, নিজের জন্য সময় বের করুন, নিজেকে প্রস্তুত করুন নতুন কিছু করার। পরিবার আপনার আসল, তাদের জন্য বাঁচুন, তাদের জন্য সুস্থ থাকুন, তাদেরকে সুস্থ রাখুন।
উপরের উল্লেখিত যেকোন কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে দৈনিক কার্যক্রম এর একটি রুটিন করুন এবং তা পরিবারের সবাইকে নিয়ে পালন করুন। রিলাক্সজেশন ব্যায়ামটি অবশ্যই রাখবেন রুটিনে, কারণ এটি সরাসরি Anxiety কমাতে সাহায্য করে।
আপনার ঘরের পরিবেশ আপনি আপনার মত করে তৈরী করুন। মনে রাখবেন একটি কথা ২০২০ সালে আপনি কত টাকা আয় করলেন, কত পড়াশুনা করলেন, কত ডিগ্রি নিলেন তার কোন কিছুরই হিসাব করবেন না।
এই ২০২০ সালে বেঁচে থেকে পার করাটাই একটি সবচেয়ে বড় পাওনা আল্লাহতালার কাজ থেকে।

সবাই সুন্দর ও সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন এই দোয়া করি। আপনারাও আমার এবং আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন, আমিন।

#ধন্যবাদ

(((ডাঃ তারেক আহমদ, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড)))

আরো পড়ুন