শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রকাশিত : ৮:০৯ অপরাহ্ন শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
বিনোদন ডেস্ক,দেশবাংলা ডটনেট
আইয়ুব বাচ্চুকে আর চোখে দেখব না; তার গান শুনব খোলা আকাশের নিচে- এই নির্মম সত্য মেনে নেওয়া আমার জন্য খুবই কঠিন। আইয়ুব বাচ্চুর মঞ্চ উপস্থাপনা যারা দেখেছেন, প্রত্যেকে জানেন- কী ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা তার! গিটারের সুরে আর ভরাট গায়কীতে কী অবিশ্বাস্য দক্ষতায় তিনি দর্শক-শ্রোতাদের সম্মোহনে ফেলে দিতেন! আর, আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে এর বাইরে আমার কয়েক দশকের বন্ধুত্ব, অভিমান, রাগ-অনুরাগের সম্পর্কও জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গীতের ইতিহাস লিখতে হলে; না, আমি শুধু ব্যান্ড সঙ্গীত বলব না; সামগ্রিক সঙ্গীতের ইতিহাসেই আইয়ুব বাচ্চু অসামান্য প্রতিভাধর এক জাদুকরের নাম। তিনি ভালোবাসায় জড়িয়েছেন বাংলা গানের কোটি কোটি অনুরাগীকে। খুব কাছের একজন বন্ধু হিসেবে আমি জড়িয়ে গেছি তার সঙ্গে গভীর অন্তরঙ্গতায়। আবার কখনও অভিমানে দূরে থেকেছি। সব মিলিয়ে ভালোবেসেছি এই কিংবদন্তিতুল্য শিল্পীকে।
কখনও আর দেখা হবে না আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে; হবে না প্রাণ খুলে আড্ডা দেওয়া। বারবার তাই পুরনো দিনগুলোর স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, যেখানে আমরা চলার পথকে প্রসারিত করার স্বপ্ন বুনেছি। আশি দশকের কথা। লিড গিটারিস্ট হিসেবে ফিলিংস ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হন আইয়ুব বাচ্চু। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। এর পর কত আড্ডা, গানের মধ্য দিয়ে সময় চলে গেছে, তার হিসাব মেলানো কঠিন। তখনই জেনেছিলাম, সঙ্গীতের জন্য আইয়ুব বাচ্চু কতটা নিবেদিতপ্রাণ!
শিল্পী, গীতিকবি আর সুরকার হিসেবে তার পথচলা মসৃণ ছিল না। পরিবারের অসম্মতি আর অনেক বাধা পেরিয়ে, দিনের পর দিন সংগ্রাম করেই শিল্পী হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা। সে ইতিহাস গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। তার কাছেই শুনেছিলাম, গিটারের নেশায় কীভাবে ছুটে গেছেন এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে! গত বছর একক গিটার শোতে সবাইকে শুনিয়েছিলেন গিটারের প্রেমে পড়ার ইতিহাস। বলেছিলেন, গিটারের প্রতি তার ভালোবাসার জন্ম কৈশোরে। সেটা সত্তর দশকের শুরু। নিজের কোনো গিটার ছিল না। সামর্থ্যও ছিল না গিটার কেনার। পরিচিত একজনের গিটার ছিল, যে ভাড়া দিত। কয়েক মাইল পথ হেঁটে গিয়ে তার কাছে যেতেন গিটার ভাড়া নিতে। ৩০ টাকায় ভাড়া নেওয়া গিটার দিয়েই বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতেন। শো থেকে পাওয়া ৭০-৮০ টাকার প্রায় অর্ধেক চলে যেত গিটার ভাড়া দিতে। তাকে প্রশ্ন করছি- গান গাওয়ার চেয়ে গিটার বাজাতেই কি বেশি ভালো লাগে?
এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। কারণ উত্তরটা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট ছিল না। এ কথা ঠিক, গিটার ছাড়া আইয়ুব বাচ্চু কোনো আয়োজনে অংশ নেওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি। অনেকবার বলেছেন, গিটার হলো তার তৃতীয় হাত।
আমার ধারণা, আইয়ুব বাচ্চুর তুল্য গিটারবাদক সমগ্র এশিয়াতেই বিরল। আর এই দক্ষতা অর্জনে তাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। আশির দশকে আমরা যারা সঙ্গীত যুদ্ধে নেমেছিলাম, তারা প্রত্যেকেই জানি, কতটা কাঠখড় পুড়িয়ে এত দূর আসতে হয়েছে! তাই গানের সুবাদে হলেও আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে পরবর্তীকালে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়।
যদিও আমাদের একই ব্যান্ডের হয়ে গান করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সময়ের পালা বদলেও বন্ধুত্ব অটুট থাকে। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে কাজ করতে করতে জুটি হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠি আমরা। ‘বাচ্চু-জেমস’ কিংবা ‘জেমস-বাচ্চু’- যেভাবেই বলা হোক, আমাদের এই জুটি অ্যালবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে রেকর্ড গড়ে। নিকোলাসের তত্ত্বাবধানে ‘টুগেদার’ অ্যালবামে আমরা প্রথম একসঙ্গে কাজ করি। পরের বছর প্রিন্স মাহমুদের ‘শক্তি’ মিক্সড অ্যালবামে। আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ড ‘এলআরবি’র সঙ্গে আমাদের ‘ফিলিংস’ ব্যান্ড দুটি অ্যালবামে যৌথভাবে কাজ করেছে। কিন্তু তখনও ভাবিনি, পরবর্তীকালে আমরা আলাদা করে সঙ্গীত জুটি হয়ে যাব! এটা হয়েছে মূলত শ্রোতাদের আগ্রহে। প্রিন্স মাহমুদের সুরে ‘পিয়ানো’ অ্যালবামে আমরা জুটি হয়ে গান করার পর থেকেই এটা শুরু হয়। এর পর ‘দেশে ভালোবাসা নাই’, ‘যন্ত্রণা’, ‘মাটি’, ‘দিল’, ‘প্রতারণা’, ‘দীর্ঘশ্বাস’, ‘ভালোবাসতে মন লাগেরে’সহ অনেক অ্যালবামে গান করেছি আমরা। এর পাশাপাশি দেশ-বিদেশে কত স্টেজ শোতে একসঙ্গে অংশ নিয়েছি তার কোনো লেখাজোখা নেই।
এই যে একসঙ্গে দিনের পর দিন গান করে যাওয়া- এর মধ্য দিয়েই জীবনের নানা অভিজ্ঞতার অংশীদার হয়েছি আমরা। একে অপরকে জানতে, বুঝতে পেরেছি বলেই একসঙ্গে নতুন আয়োজন নিয়ে মেতে উঠতে পেরেছি যখন-তখন। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগিও করেছি দু’জন। আইয়ুব বাচ্চুর মতো মেধাবী ও মানবিক বন্ধুর প্রয়াণে আমি আরও নিঃসঙ্গ হলাম। তবে আমাদের আবার দেখা হবে, আমি নিশ্চিত- আইয়ুব বাচ্চুর আর্দ্র সুর আর কথার কালজয়ী গানগুলো বারবার আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে; আমি জানি। তবে, মানুষী দুঃখ থাকবেই- তাকে চর্মচক্ষে আর দেখব না। জীবন এত রূঢ়! বিদায়, বন্ধু।