শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

আজিজ বোর্ডিংয়ের সেই ভবঘুরের আজকের জেমস হওয়ার গল্প

প্রকাশিত : ৮:২৩ অপরাহ্ন শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে ব্যান্ড দলগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন দখল করে আছে। সেই আশির দশক থেকে পপ সম্রাট আজম খানের হাত ধরে কিছুটা ভিন্নধর্মী এই সঙ্গীতের যে ভিত গড়ে উঠেছিলো তা সোলস, মাইলস, ফিডব্যাকসহ আরো অনেক ব্যান্ড দলের সমন্বয়ে শক্ত এক অবস্থানে পৌঁছে যায়। এই ধরনের সঙ্গীতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভোকালের চেয়ে সেই ব্যান্ড দলের নামই সবার কাছে বেশি পরিচিত হয়। তবে এই ব্যান্ড সঙ্গীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের নাম নিজেদের ব্যান্ড দলকে ছাড়িয়ে বহুদূর ছড়িয়ে গেছে। এমন একজন শিল্পী হচ্ছেন জেমস, যিনি স্বতন্ত্র এক দরাজ গলা দিয়ে জনপ্রিয়তার অস্বাভাবিক এক উচ্চতায় আসীন হয়েছেন।

জেমসের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২রা অক্টোবর, পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। শিল্পী জেমসকে কিছুটা অন্তর্মুখী মনে হলেও ছেলেবেলায় ভীষণ দুরন্ত ছিলেন তিনি। শৈশবে সেভাবে গানের সাথে জড়িত ছিলেন না, মূলত কলেজে থাকা অবস্থাতেই গানের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু বাবা মোজাম্মেল হক কিংবা মা জাহানারা খাতুন কেউই চাননি যে তাদের ছেলে গানের দলে যুক্ত হোক। বাবা চাইতেন তারা ছেলেও তার মতোই সরকারি উঁচু পদে কর্মরত হবে। শেষপর্যন্ত গানের টানে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসেন জেমস, ঠাঁই নেন চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিংয়ে।

ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে বন্ধুদের সাথে জেমস; Image Credit : সাঈদ মাহমুদ শাওন

আজিজ বোর্ডিং থেকেই সঙ্গীতের ভুবনে পুরোপুরি জড়িয়ে যান জেমস, বন্ধুদের নিয়ে ভেঙে যাওয়া ব্যান্ড দল ফিলিংসকে আবারো নতুনভাবে গঠন করেন। প্রথমদিকে মূলত ইংরেজি গানগুলোর কভারই করতেন তারা, কিন্তু একপর্যায়ে বুঝতে পারলেন যে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে মৌলিক গানের উপরে জোর দিতে হবে। নিজের ব্যান্ড দলের একক অ্যালবাম করার জন্য ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন জেমস ও তার বন্ধুরা। পরের বছরেই বের করেন নিজেদের প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’। এই অ্যালবামের সবগুলো গানের সুর জেমস নিজেই করেছিলেন। ব্যবসায়িকভাবে অ্যালবামটি সফল না হলেও নিজের মৌলিক কন্ঠ দিয়ে তাক লাগিয়ে দেন এই শিল্পী।

নব্বইয়ের দশকে ফিলিংসের সদস্যদের সাথে জেমস; Image Source: Bangladesh Old Photo Archive

১৯৮৮ সালে বের হয় জেমসের প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’। তিনি প্রথম আলোড়ন তোলেন ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামটির মাধ্যমে। এটি ছিল ফিলিংসের দ্বিতীয় অ্যালবাম। ফাঁসির এক আসামীর শেষ দিনগুলো নিয়ে অসাধারণ এক গান ছিল জেল থেকে বলছি  গানটি। এই একটি গানের মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যান তিনি।

এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। এতক্ষণ যেসব গানের কথা বলা হলো সেসব গানে জেমসের গলা আর পরের দিকের গানে জেমসের গলার ধরনে বেশ তফাৎ রয়েছে। আসলে সাইকিডেলিক রক ধরনের গান শুরু করার পর থেকেই জেমস কিছুটা উচ্চস্বরে গান গাইতে শুরু করেন। বাংলাদেশের সঙ্গীত ইতিহাসে জেমসই প্রথম এই ধরনের গান শুরু করেন।

১৯৯৬ সালে নগর বাউল  নামে একটি অ্যালবাম বের করে জেমসের ব্যান্ড দল ফিলিংস। তার ক্যারিয়ার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায় ১৯৯৭ সালে। এ বছর বের হওয়া ‘দুখিনী দুঃখ করো না’ একক অ্যালবামটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অ্যালবামে মোট ১২টি গান থাকলেও সুলতানা বিবিয়ানা, তুমি যদিও নদী হও ও দুখিনী দুঃখ করো না- এই তিনটি গান অস্বাভাবিক রকমের জনপ্রিয়তা লাভ করে। গানগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে মুক্তির ২১ বছর পর আজও এই গানগুলো মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়।

পরের বছর নিজের ব্যান্ড দলের সাথে বের করেন ‘লেইস ফিতা লেইস’ অ্যালবামটি। এই অ্যালবামের মাধ্যমে ফিলিংস নামটি ছেড়ে নগর বাউল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দলটি। এই অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাকের সাথে ‘পথের বাপ’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। গানের কথাগুলো যেন রাস্তায় বেড়ে ওঠা অসংখ্য পথশিশুর মনের কথা বলে দেয়।

পথের বাপই বাপরে মনা,
পথের মা’ই মা,
এই পথের বুকেই খুঁজে পাবি
আপন ঠিকানা।

শুধু পথশিশুই নয়, এই গানগুলো যেন আজিজ বোর্ডিংয়ে কাটানো জেমসের সেই নিঃসঙ্গ দিনগুলোর কথাও নীরবে বলে দেয়। ১৯৯৯ সালে বের হয় তার চতুর্থ একক অ্যালবাম ‘ঠিক আছে বন্ধু’। এই অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান এপিটাফ। গানটি শুনলে যেকোনো মানুষের বুকেই নাড়া দিয়ে উঠবে। এছাড়া মীরাবাঈ গানটাও ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এদিকে ব্যান্ড অ্যালবাম ও একক অ্যালবাম বের করার পাশাপাশি মিক্সড অ্যালবামেও কাজ করা শুরু করেন জেমস। এই মিক্সড অ্যালবামে কাজ করতে গিয়েই প্রিন্স মাহমুদের সাথে কাজ শুরু করেন তিনি। এমনই একটি মিক্সড অ্যালবাম ছিল ‘এখনও দু’চোখে বন্যা’। প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে এই অ্যালবামে কালজয়ী একটি গান করেন জেমস। গানটির নাম ‘মা’। মা হারা এক ছেলের ব্যথা যেভাবে এই গানে তুলে ধরা হয়েছে তা শুনলে যেকোনো মানুষই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয়তার চূড়ায় উঠে যান জেমস; Image Source : Srijonmusicbd

পরের বছরে প্রিন্স মাহমুদের সাথে আরো একটি হৃদয়স্পর্শী গান উপহার দেন জেমস, নাম ‘বাবা’। হারজিত অ্যালবামের এই গানটিও শ্রোতাদের মনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয়। অসাধারণ কিছু গান, সাইকিডেলিক রক সাথে অনন্য এক দরাজ কণ্ঠ – সব মিলিয়ে জেমসের জনপ্রিয়তা অন্য এক পর্যায়ে চলে যায়। সেই মাত্রাটা এতটাই উঁচুতে উঠে গিয়েছিলো যে কিছু ভক্তের জীবনের সবকিছুই যেন এই শিল্পী হয়ে ওঠেন। ভালোবেসে ভক্তরা তাকে ‘গুরু’ বলে ডাকতে শুরু করেন।

২০০০ সালে আরেক ইতিহাসের অংশ হন জেমস। বাংলা সঙ্গীতের রাজপুত্র প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে ব্যান্ড সঙ্গীতের আরেক লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর সাথে পিয়ানো  নামের একটি ডুয়েট অ্যালবাম সেই বছরের ডিসেম্বরে মুক্তি পায়। বাংলাদেশের সঙ্গীত ইতিহাসে সেরা ডুয়েট অ্যালবামগুলোর তালিকা করলে একদম উপরের দিকেই এই অ্যালবামটি থাকবে। আইয়ুব বাচ্চুর দুনিয়া, তাজমহল গানগুলোর সাথে গুরু জেমসের বাংলাদেশ, এক নদী যমুনা, তুমি জানলে না গানগুলো এই অ্যালবামেরই ছিল।

পিয়ানো অ্যালবামের প্রচ্ছদ; Image Credit: Prince Mahmud

এই অ্যালবামটির অভাবনীয় সাফল্য জেমসের ক্যারিয়ারকে কিছুটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়, ব্যান্ড দলের সাথে অ্যালবাম করার পরিবর্তে প্রিন্স মাহমুদকে সাথে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর সাথে ডুয়েট অ্যালবামের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। ২০০১ সালে মুক্তি পায় নগর বাউলের ‘দুষ্টু ছেলের দল’ অ্যালবামটি। এই অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক ছাড়াও বিজলী গানটিও ভীষণ জনপ্রিয় হয়।নিজের ব্যান্ড দলের সাথে এটিই ছিল তার শেষ অ্যালবাম।

উপরে উল্লেখিত গানগুলো বাদেও প্রিন্স মাহমুদের সাথে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন জেমস। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা’, ‘কিছু ভুল ছিল তোমার’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘পাপী’ ইত্যাদি। প্রিন্স মাহমুদ ছাড়াও আরো অনেক জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকারের সাথে কাজ করেছেন তিনি। লাকি আখন্দের সুরে ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, কবি শামসুর রাহমানের কথায় ‘তারায় তারায়’ আর জুয়েল বাবুর সুরে ‘পদ্মপাতার জল’ আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়।

২০০৩ সালে জেমসের পঞ্চম একক অ্যালবাম আমি তোমাদেরই লোক  মুক্তি পায়। এই অ্যালবামের ‘সেলাই দিদিমণি’ গানটি গার্মেন্টস কর্মীদের উৎসর্গ করে রচিত হয়।

দিদিমনি নিও তুমি আমার ভালবাসা
তোমার চোখে দেখি আমি রঙিন দিনের আশা

 

পোষাক শ্রমিকদের হাত ধরে দেশের অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাগুলো কী সহজভাবেই না এই লাইনগুলোতে বলে দেওয়া হয়েছে। গানটি তুমুল জনপ্রিয়তার সাথে সমালোচকদের মনও জয় করে নেয়। ২০০৫ সালে মুক্তি পায় জেমসের ষষ্ঠ একক অ্যালবাম জনতা এক্সপ্রেস

২০০৬ সালে প্রীতমের সুরে হিন্দি ছায়াছবি গ্যাংস্টারে গান গেয়ে নতুন ইতিহাস গড়েন জেমস। তার গাওয়া ‘ভিগি ভিগি’ টানা একমাস টপচার্টের শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছিলো। গানটির জনপ্রিয়তার কারণে আরো অনেক হিন্দি ছবিতে গান গাওয়ার প্রস্তাব তার কাছে আসতে থাকে। সেই বছরেই ও লামহে  ছবিতে ‘চাল চালে’ নামের একটি গানেও গলা মেলান জেমস। তবে গানটা তো আজীবন আনন্দের জন্যই গেয়েছেন তিনি, আর হিন্দিতে গান গেয়ে সেই আনন্দটা একদমই পাচ্ছিলেন না। এ কারণেই অনেক প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও হিন্দি ছবির প্লেব্যাকে নিয়মিত হননি তিনি।

বাংলাদেশের মতো ভারতেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন জেমস; Image Source : Dailypage3.com

বাংলা চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে জেমসকে আনার চেষ্টা বহু আগে থেকেই করা হচ্ছিলো। যদিও জেমসের কিছু গান চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিলো, কিন্তু শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের জন্য গান গাওয়ার ব্যাপারে তার কিছুটা অনীহা ছিল। শেষপর্যন্ত জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মান্নার অনুরোধে মনের সাথে যুদ্ধ সিনেমার ‘আসবার কালে’ গানটির মাধ্যমে প্রথমবার বাংলা চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন গুরু। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে আটটি বাংলা চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন তিনি। ২০১৪ সালে ‘দেশা আসছে’ গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন জেমস।

২০০৭ সালে জেমসের সপ্তম একক অ্যালবাম ‘তুফান’ মুক্তি পায়। পাইরেসির কারণে ২০০৭ সালের পর থেকেই জেমসের নতুন গান আসায় বিশাল এক ভাটা পড়ে যায়। জেমসের সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘কাল যমুনা’ বের হয়েছিলো ২০০৮ সালে। এরপর আর কোনো একক অ্যালবাম তার বের হয়নি। বিভিন্ন কনসার্ট আর মিউজিকাল শো-তে গান গেয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন জেমস।

কনসার্টে জেমসের উপস্থিতি মানেই অন্যরকম এক উন্মাদনা; Image Source : The Daily Star

কনসার্টে জেমসের উপস্থিতি মানেই এক অন্যরকম উন্মাদনা। আসছে ২ অক্টোবর ৫৪ বছর পূর্ণ করে ৫৫-তে পা দিতে যাচ্ছেন তিনি। এই বয়সেও যেভাবে দাপটের সাথে মঞ্চ মাতিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিই অভাবনীয়। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “ভক্তদের অসীম ভালোবাসা শক্তি জোগায়। যখন মঞ্চে উঠি তখন মানুষের ভালোবাসার তীব্রতা টের পাই।” ভক্তদের ভালোবাসা সাথে নিয়ে আরো অনেক দিন এভাবেই গুরু আমাদের সুরের তালে মাতিয়ে রাখবেন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরো পড়ুন