সোমবার, ২৯ মে ২০২৩
প্রকাশিত : ২:০৪ পূর্বাহ্ন সোমবার, ২৯ মে ২০২৩
ওমর ফারুক
তখন সবে আমি ক্লাস ফাইভে উঠেছি। পাহাড়ে আমাদের লালমাটির বাড়ি থেকে
দঃ সোনাইছড়ি প্রাইমারি স্কুল ছিলো তিন কিলো মিটারেরও বেশি দূরে। গহীন জঙ্গল ছিদ্র করে যাওয়া রাস্তা ধরে যেতে হতো প্রায় দুই কিলো। তারপর সবুজ বিলের মাঝ ধরে বেয়ে চলা আঁকাবাকা আইল ধরে যেতে হতো আরো এক কিলোমিটার। পথে একটা বাঁশের সাঁকোও পড়ত। আমাদের ছিলো টানাপোড়েনের সংসার। মা কোন রকম ডালভাত দুইটা খাইয়ে আমাকে স্কুলে পাঠাতেন। তখন আমাদের পুরো মৌলভী পাড়া পাহাড়ের হাতেগোনা কয়েকজন স্কুলে যেতাম।
গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিলো বারবাকিয়া বাজার। সিডি তখনো আসেনি। ভিসিআরের রমরমা অবস্থা ছিলো। মা সকালে আমাকে পাঠাতেন স্কুলে আর আমি বন্ধুদের সাথে চলে যেতাম ভিসিআর দেখতে বাজারে। টাকা পয়সা তেমন সমস্যা ছিলো না। পাহাড়ে গিয়ে একদিন লাকড়ি এনে বিক্রি করলে বিশ-ত্রিশ টাকা পাওয়া যেতো। তা দিয়ে মোটামুটি দিনে দুইটা করে দশটা বই(সিনেমা) দেখতে পারতাম।
মা জানতেন আমি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। বড়ভাই পড়ালেখা ছেড়ে দিলেও মা আমাকে নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন। একদিন জজ ব্যারিস্টার কিছু একটা হবো। এভাবে প্রায় ছয়মাস স্কুলে না যাওয়ার পর মা একদিন জানতে পারেন আমি স্কুলে যাচ্ছি না।
এক বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভী জামাল স্যার আমাদের বাড়িতে এসে মাকে আমার স্কুলে না যাওয়ার গোমর ফাঁস করে দেন। স্যারকে দেখে আমি পালিয়ে যাই। মা অনেক মাইরদোর করে পরেরদিন থেকে বইখাতা নিয়ে স্কুলে পাঠালেও আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি। বিলে মাছ ধরতাম, চুরি করে মানুষের খেতের মিষ্টি আলু উঠাতাম, খালে মরিচ খেলা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম কিংবা চিলহান্টার নিয়ে পাখি শিকারের জন্য ঘুরে বেড়াতাম। কানের ফাঁকে কাদা কিংবা ভেজা চুল দেখে স্কুলে যাইনি বুঝতে পারলে, মা মারতেন। জামাল স্যার আরো একবার দিনের বেলায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন এবং সেবারও স্যারকে দেখে পালিয়ে যাই।
স্যারের সাথে চোর পুলিশ খেলা খেলতে খেলতে টানা আট মাস চলে যায়। একদিন রাত আটটায় জানালা দিয়ে দেখি জোনাকি পোকার মতো একটা আলো মিটিমিটি করে আমাদের বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছিলো। প্রথমে কোন প্রতিবেশীর আগমন মনে করলেও বস্তুত হারিকেন জ্বালিয়ে সেদিন জামাল স্যার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। পালাতে চাইলেও রাত থাকায় সেদিন পালাতে পারিনি। চেয়ারের পাশে বসিয়ে স্যার অনেক কথা বলেছিলেন। সব কথা মনে না থাকলেও একটা কথা স্পষ্ট মনে আছে এখনো- নিজের কপাল নিজে খাইস না।
পরের দিন থেকে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করি। প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে এখন শিক্ষা নিয়ে কাজ করি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমার স্যার মারা যান। সুযোগ পেলে স্যারের কবর জিয়ারত করে আসি।
পেশাগত কারনে এখন শিক্ষকদের সাথে কাজ করতে হয়। তাদেরকে জামাল স্যারের কথা বলি। জামাল স্যার হোম ভিজিট করে আমাকে ঝরে পড়া থেকে ফিরিয়ে আনার কথা বলি। এখন প্রতি মাসে অন্তত একটা ঝরে পড়া শিশুকে হোম ভিজিট করে স্কুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। যতবারই হোম ভিজিটে যাই জামাল স্যারের কথা মনে পড়ে, নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। চোখ ভিজে আসে। সম্মানিত শিক্ষকদের হোম ভিজিট করে ড্রপ আউট শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসার জন্য মোটিভেট করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিশ্বাস করি প্রত্যেক শিক্ষক মাসে একজন করে ড্রপ আউট কমাতে পারলে আমার আওতাধীন এলাকায় ঝরেপড়া একদিন শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। হারিকেনের মিটিমিটি আলো দিয়ে আমার অন্তরে জামাল স্যার যে আলো জ্বালিয়েছিলেন, সেই আলো জ্বালানোর কাজই আমি করি। আমার এসব দেখে স্যার স্বর্গে বসে এখন নিশ্চয়ই হাসছেন।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা
লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।