বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

স্মৃতির নোট বুক”

প্রকাশিত : ১১:৫৮ অপরাহ্ন বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

প্রসঙ্গঃ বন্ধুবর মাওলানা আবদুল হাই নদভী

বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, “প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু, বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়”। বন্ধুত্ব একটি শক্তিশালী বন্ধনের নাম। বন্ধুত্ব স্বার্থহীন সামাজিক সম্পর্ক। যে সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি। বন্ধুত্বের বন্ধন নিয়ে আসে মরুভূমি সমতুল্য হৃদয়ের মাঝে সবুজ অরণ্যে ঘেরা এক মায়াবন্ধনে সিক্ত আলিঙ্গন। একজন বন্ধুই পারে আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে। আমার জীবনের মোড়কেও ঘুরিয়ে দিয়েছিল আমার এক বন্ধু। তিনি আর কেউ নন; বায়তুশ শরফের বর্তমান সম্মানিত পীর সাহেব মাওলানা আব্দুল হাই নদভী।
পরিচয় ১৯৭৭ সালের দিকে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায় অধ্যয়নের সুবাদে। দু’বছর অধ্যয়ন শেষে চলে গেলেন বাবার প্রতিষ্ঠিত দরছে নেজামী আদলে প্রতিষ্ঠিত কুমিরাঘোনা শাহ আখতারিয়া মাদ্রাসায়। চুনতি মাদ্রাসাস্থ হেফজখানায় অধ্যয়নরত তাঁর ইমিডিয়েট ছোটভাই আবদুর রহিম (শহীদ) হয়ে উঠে আমার বন্ধু এবং খেলার সাথী। মাদ্রাসার বিশাল মাইট্যা গুদামের হোস্টেল ভবনে আমি আর বেলাল (মরহুম পীর সাহেব বাহরুল উলুম মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেবের একমাত্র পুত্র সন্তান) থাকতাম পাশাপাশি চৌকিতে। পাশের রুমে থাকতো আমার আরেক বাল্যবন্ধু অধ্যাপক ড. আবুল আলা মো. হোছামুদ্দিন, তাঁর বাবা তদানীন্তন চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার নাজেমে আলা আল্লামা ফজলুল্লাহ (রাহঃ) এর সাথে। হাফেজ আবদুর রহিমসহ আমরা প্রতিদিন আসরের নামাজ পর সদ্য ভরাটকৃত সীরাত মাহফিল ময়দানে খেলাধূলা করতাম। আবদুর রহিম হেফজুল কোরআন শেষ করে বাবার তত্বাবধানে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে বায়তুশ শরফ চলে আসলে সম্পর্কে ছেদ পড়ে। তখনতো যোগাযোগ এতো সহজ ছিলনা।
এদিকে আবদুল হাই নদভী এশায়াআতুল উলুম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করে ১৯৮৪ সালে চুনতি মাদ্রাসায় আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। শুরু হয় বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায়। বায়তুশ শরফের সম্মানিত পীর সাহেবের ছেলে ছাড়াও তার সৌখিন চলাফেরা, মার্জিতরুচি বোধ, অমায়িক ব্যবহার, বন্ধুবৎসল্যতা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সকলের নজর কাড়ে। চুনতি মাদ্রাসার হেড মাওলানা হিসেবে সুপরিচিত আমার পিতৃবৎ মামা মরহুম মাওলানা কামাল উদ্দিন মুছা খতিবী (রাহঃ) তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং বিকেলে মামার জন্য তৈরি নাস্তা মাঝেমধ্যে আমাদের ডেকে খাওয়াতেন।
১৯৮৬ সালে আবদুল হাই নদভী ভারতের উত্তর প্রদেশের বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র নাদওয়াতুল ওলামা, লক্ষ্ণৌ’তে চলে যাওয়ার পর সম্পর্কের তৃতীয় মাত্রার সূচনা হয়। সপ্তাহান্তে দু’ একটি পত্রের আদান-প্রদান হতোই। আজ খুব মনে পড়ছে পশ্চিম চুনতির তদানীন্তন অত্যন্ত শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তিত্ব মরহুম আব্দুল্লাহ মিয়ার কথা, যিনি শখের বসে পোস্ট মাস্টারি করতেন। সম্পর্কে আমার আত্মীয় ছিলেন। চিঠি আসলে দূর থেকে দেখেই রসিকতার সাথে বলতেন, “হিন্দুস্তানচে পিয়ারে দোস্তকা চিঠ্ঠি আয়া”। চিঠির পাশাপাশি আমার ঠিকানায় নিয়মিত পাঠাতো উর্দু পাক্ষিক “তা’মিরে হায়াত”। মাঝেমধ্যে পাঠাতো আরবী “আর-রাইয়েদ” ও “আলবাআছ”। তা’মিরে হায়াতের অসংখ্য কপি এখনো আমার সংরক্ষণে। বন্ধুর পাঠানো উর্দু চিঠি এবং তা’মিরে হায়াত পড়তে পড়তে উর্দু ভাষার উপর আমার বেশ দক্ষতা চলে আসে। বছরখানিক পর প্রিয়বন্ধু আবদুল হাই নদভী আমাকেও অধ্যয়নের জন্য লক্ষ্ণৌতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে দেশে বেড়াতে আসলে মামার সাথে সাক্ষাতকালে আমাকে নদওয়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলে মামা সম্মতি দেন। কিন্তু, আমার মায়ের অশ্রুসিক্ত অসম্মতিতে আর যাওয়া হলোনা। এমনটি না হলে হয়তো আমার নামের শেষেও আজ শোভা পেত ‘নদভী’ লকব!! নদওয়া’র গুণগান শুনতে শুনতে তা স্বচক্ষে দেখার বড্ড স্বাদ মিটিয়েছিলাম ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌ সফরকালে। আব্দুল হাই নদভী নদওয়াতুল উলামায় অধ্যয়নের পাশাপাশি চুনতি মাদ্রাসা হতে আমাদের সাথে আলিম (১৯৮৬) ফাযিল (১৯৮৮) আর কামিল (১৯৯০) পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। দাখিল পরীক্ষায় আমার একবছর পূর্বে অংশ নিলেও বাকি তিনটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় একসাথে অংশ নিই।

এবার আসি সম্পর্কের চতুর্থ অধ্যায়ে, যা আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মাওলানা আবদুল হাই নদভী ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে বায়তুশ শরফের খেদমতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। আনজুমনে নওজোয়ানকে সুসংগতি করার পাশাপাশি বায়তুশ শরফ থেকে প্রকাশিত মাসিক “দ্বীন-দুনিয়া” ও “কিশোর দ্বীন-দুনিয়া” এর বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং কিছুদিন পর বায়তুশ শরফ কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যোগ দেন। এদিকে আমি ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্সে ভর্তি হই। কিছুদিন আলাওল হলে অবস্থানের পর লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু একটা করার উদ্দেশ্য নিয়ে শহরে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। কাকতালীয়ভাবে আমার আবাসন ঠিক হয় বায়তুশ শরফের দু’শ গজ ব্যবধানে দেওয়ানহাটের অধিপতি সোলতান দেওয়ানের বাড়িতে; একাধারে পাঁচ বছর রাজকীয় হালতে লজিং বাড়ি। এসময় হররোজ বায়তুশ শরফ যাওয়া হতো বন্ধু আবদুল হাই নদভী’র সাথে আড্ডা দিতে এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়তে। পাশে থাকতো দ্বীন-দুনিয়া’র নির্বাহী সম্পাদক জাফর উল্লাহ ভাই। আলোচনা হতো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। পত্রিকা পাঠের নেশা সেই আমার বাল্যকাল থেকে। চুনতি মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন অনেকসময় আসা-যাওয়া বাবদ দু’টাকা গাড়ি ভাড়া খরচ করে এক টাকা মূল্যের জাতীয় পত্রিকা আনতে আমিরাবাদ চলে যেতাম। পত্রিকার নেশা এভাবেই পেয়ে বসেছিল আমায়! ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে বন্ধুবর আবদুল হাই নদভী প্রস্তাব দিলেন দ্বীন-দুনিয়ায় লেখালেখি করতে; উৎসাহিত করলেন জাফর উল্লাহ ভাইও। জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক দেওয়ান আজরফ, কবি আল মাহমুুদের মতো বড়োমাপের লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ থাকতো তখনকার মাসিক দ্বীন-দুনিয়া। ভয় আর ইতস্ততার মাঝে প্রিয়জনার আহবানে সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়ে লেখালেখি শুরু করলাম। একটি বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত না করলে মনে আজকের লেখায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। তাহলো- ১৯৯৪ সালে গারাংগিয়ার ছোট হুজুর কেবলা হযরত শাহসুফি মাওলানা আব্দুর রশিদ হামেদী (রাহঃ) এর ইন্তেকালের সপ্তাহ দু’য়েক পর আবদুল হাই ভাই একদিন আমাকে বললেন, গারাংগিয়া মাদ্রাসার মাহফিল উপলক্ষে ছোট হুজুরের নামে বিশিষ্ট লেখকদের লেখা নিয়ে একটি স্মরণিকা বের করলে ভালো হয় এবং বিজ্ঞাপনও পাওয়া যাবে প্রচুর। উল্লেখ্য, এসময় আবদুল হাই নদভীও লেখালেখিতে প্রচুর মনোনিবেশ করেন এবং তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা থাকলেও আমি ছিলাম একেবারে অর্বাচিন। তিনি সাহস দিলেন। তাঁর প্রস্তাবটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হযরত ছোট হুজুর (রাহঃ) এর মেঝ ছেলে মরহুম মাওলানা ফরিদুল ইসলাম (রাহঃ)’র (যিনি আমাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন) সাথে কথা বললাম এবং উদ্যোগটির কথা শুনে অনেক খুশি হলেন। সিদ্ধান্ত হলো, প্রকাশিত স্মরণিকাটি হবে হযরত বড় হুজুর ও ছোট হুজুরের নামে। আবদুল হাই ভাই বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক চৌধুরী গোলাম রব্বানী ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যিনি ছোট হুজুরের তত্বাবধানে গারাংগিয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক আল ইসলামের সম্পাদক ছিলেন; সম্পৃক্ত ছিলেন বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রের সাথেও। রব্বানী ভাইয়ের গাইড লাইন মোতাবেক কাজ শুরু করলাম। হাতে সময় ছিল মাত্র ৩৫ দিন। বিশিষ্টজনদের বাণী আর লেখা সংগ্রহের পাশাপাশি প্রচুর বিজ্ঞাপনও আসতে শুরু করলো। সদ্য ওফাতপ্রাপ্ত হযরত ছোট হুজুরের স্মরণে স্মরনিকার কথা শুনে অনেকে বিজ্ঞাপন প্রকাশের পূর্বেই টাকা দিতে লাগলো। দু’ হাজার কপি স্মরণিকা ছাপা এবং আনুষাঙ্গিক ব্যয় বাদে আমার কাছে অবশিষ্ট থাকলো ভালো মানের উদ্বৃত্ত; তার উপর স্মরণিকা বিক্রিলব্ধ টাকা।
এদিকে দ্বীন-দুনিয়ায় প্রকাশিত অধমের লেখা সুধী পাঠক মহলে সমাদৃত হতে দেখে কর্তৃপক্ষের মাঝে যেমন আমার লেখার প্রতি আগ্রহ দেখা দিলে আমার উৎসাহ-উদ্দীপনাও বেড়ে গেলো। মাসিক দ্বীন-দুনিয়া’র আন্তর্জাতিক বিভাগে একাধারে আটবছর আমার লেখা ছিল প্রায় প্রতি সংখ্যায়। মরহুম হুজুর কেবলা আল্লামা শাহ আবদুল জব্বার (রাহঃ) এর হাত থেকে দু’বার লেখক হিসেবে পুরস্কার গ্রহনের সুযোগ হয়েছিল। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আবদুল হাই ভাই একদিন বললেন, দৈনিক পূর্বকোণ এবং আজাদীতে লেখা পাঠাতে। বললেন, তাদের মনঃপুত হলে ছাপাতে পারে। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বন্ধুর চাপাচাপিতে দৈনিক পূর্বকোণে প্রথম লেখা পাঠাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর স্বাধীনতা লাভকারী ও স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম অঞ্চল গুলোর ভবিষ্যত নিয়ে। প্রতিদিন সকালে পূর্বকোণের উপ সম্পাদকীয় কলাম চেক করতে থাকি। ১৯৯৪ সালের ১৪ জুলাই উপ সম্পাদকীয় কলামে আমার লেখাটি প্রকাশ হতে দেখে সেইদিনের মনের সুখের স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। এরপর আর পেছনে থাকাতে হয়নি, লিখতাম আর লিখতাম। প্রতি সপ্তাহে পূর্বকোণে লেখা প্রকাশিত হতো। মাঝেমধ্যে আজাদীতেও লিখতাম। মাস শেষে দ্বীন-দুনিয়া আর পূর্বকোণ থেকে সম্মানীও পেতাম। সেই লেখালেখির সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় দৈনিক পূর্বকোণে আমার কর্মজীবনের সূচনা হয়। বাবা আর মামারা ছিলেন আমৃত্যু শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত। সুতরাং ধমনিতে শিক্ষকতা নেশা হিসেবে কাজ না করলে সম্ভবতঃ সাংবাদিকতাকেই একমাত্র পেশা হিসেবে বেচে নিতাম। স্মর্তব্য, দৈনিক পূর্বকোণ আর মাসিক দ্বীন-দুনিয়ায় আমার লেখা প্রবন্ধ গুলোকে অনেকেই প্রফেসর ড.শব্বির আহমদের লেখা মনে করতো। মাস্টার্সে অধ্যয়নকালীন চবি’র কলা অনুষদের সামনে আমাকে পেয়ে ড.শব্বির সাহেব একদিন বলেছিলেন- “ভাগিনা, লেখছ তুই আর নাম হয় আমার। সবাই টেলিফোনে এবং সাক্ষাতে খালি আমারে ধন্যবাদ দেয়”।
এভাবেই আমার জীবনজুড়ে প্রিয়বন্ধু আবদুল হাই নদভীর বিশাল ভূমিকা, প্রভাব এবং অবদান। আরো অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। কলেবর বৃদ্ধি পাওয়াতে এখানেই ইতি টানলাম। পৃথিবীর সকল বন্ধুর বন্ধুত্ব অমর হোক। আল্লাহ হাফেজ।

লেখকঃ অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
প্রেস সচিব, মাননীয় সংসদ চট্টগ্রাম-১৫

আরো পড়ুন