মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রকাশিত : ৮:১৭ পূর্বাহ্ন মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
॥নাসিরুদ্দিন চৌধুরী॥
মধ্য আগস্টে দুনিয়া কাঁপানো অপারেশন জ্যাকপটের পর অক্টোবরে এমনি আরেকটি ঘটনায় হানাদার কবলিত চট্টগ্রাম সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠেছিলো। সেই ঘটনাটি হলো মদুনাঘাট পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস, যে বিস্ফোরণের ধামাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো। মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিস্ফোরণের পর গোটা চট্টগ্রাম অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলো। ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো হানাদার পাক বাহিনী।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ মদুনাঘাট থেকেই সমগ্র চট্টগ্রামে বিতরণ করা হতো। এরকম আর একটি সাব-স্টেশন ছিলো পোমরায়, যেটি ক্যাপ্টেন করিম উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
মদুনাঘাট অপারেশন করার জন্য ভারতের হরিণাস্থিত ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে পদোন্নতি পেয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাঁকে বীর উত্তম উপাধি দেয়া হয়েছিলো। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পতেঙ্গা বিমান বন্দরে যারা বিমান হামলা চালিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সুলতান মাহমুদও ছিলেন।
মদুনাঘাট অপারেশনের জন্য সুলতান মাহমুদ ভারত থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ৫জন নিয়মিত সৈনিক এবং পরে আরো ৫জন সৈনিক যোগ দেন। আর একমাত্র সিভিলিয়ান যিনি এই অভিযানে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন সি-ইন-সি-খ্যাত রাউজানের স্পেশাল কমান্ডার ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু। এই একটি অপারেশন করে রুমু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন।
ভারত থেকে ট্রেনিং শেষে রুমু যখন রাউজান থানার দায়িত্ব নিয়ে দেশে আসেন, সেসময় সেপ্টেম্বর মাসে রুমুর কাছে ভারত থেকে এক বড় অপারেশনের সবুজ সংকেত আসে সুলতান মাহমুদের। সে মাসেই তিনি ভারত থেকে ফটিকছড়ির নানপুর আসেন। তিনি রুমুর গ্রুপকে মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেশনের কথা বলেন। তাঁর সাথে নিয়মিত বাহিনীর ৫ জন লোক ছিল। তাদেরকে উকিল আব্দুল বারীর বাসায় একদিন রাখার পর মোবারকখীলের আকতার মিয়া, গণি সওদাগর সহ ঈদুলপুর ব্রিজের কাছে নিয়ে যান। অপারেশনের জন্য মোট ৫টি গ্রুপ করা হয়। সব গ্রুপে এক এক করে একটি পিরামিড আকারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। নদীর ঘাটে মোবারকখীল জেলে পাড়ার দুজন মাঝি সহ নৌকা ভাড়া নেয়া হয়। চলাচলের জন্য পথ নির্দেশক আকতার মিয়া, সিরাজদৌলা খাঁন, কামাল মিয়া, মো. মারুফ শাহ চৌধুরী, মো. শফিকুল আলম খান কাজ করে যাচ্ছিলেন। সব কাজ গোপনে রাতের অন্ধকারে সারতে হচ্ছিলো। অনেককে চেনা যাচ্ছিল না। সিরাজদ্দৌলা সব সময় রুমুর সঙ্গে ছিলেন। ব্রিজের নিচে ডাবুয়া খাল দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা হালদা নদীতে যান। হালদা নদী দিয়ে মাদার্শা বৈদ্যার হাটে যান। সেখান থেকে নদী পার হয়ে আবুরখীলের বিলাস বাবুর শেল্টারে যান। সেখানে রাউজানের হাসেম, মোজ্জামেল, কেদার, এবং অন্যান্য গ্রুপের দেখা পান। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীত দিকে একটি গ্রুপ ছিল। অপারেশন শুরু হয় ৭ অক্টোবর। মূল অপারেশনে ২টি নৌকা ব্যবহৃত হয়। রাউজানের আবুরখীল থেকে যাত্রা শুরু হয়।
তখন নদীর ওপারে কিছু কিছু মসজিদে আলো জ্বলছিল। টার্গেট ছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মূল কেন্দ্রে সুলতান মাহমুদ ও নিয়মিত বাহিনীর পাঁচজন এবং ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু ক্রলিং করে প্রবেশ করেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে দু’জন পাকিস্তানি সৈন্য দেখা যাচ্ছিল। রাতের আঁধারে সুলতান মাহমুদ নিজেকে একজন সৈনা পরিচয় দিয়ে প্রথমে গুলি করে পাওয়ার স্টেশনের সেন্ট্রিকে হত্যা করেন। আক্রমণের দিক বুঝতে না পেরে পাকিস্তানি সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী গ্রামের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি করতে শুরু করে। এত অল্প সময়ে সরাসরি এত বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র আক্রমণ হবে পাকিস্তানি সেনারা বুঝে উঠতে পারেনি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল করে সাবস্টেশন উড়িয়ে দেয়া হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট যুদ্ধ হয়। ১০/১২জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়।
এই অপারেশনে মান্নান নামে একজন ইপিআর-এর সদস্য মারাত্মক আহত হন। তাঁর পেটের ভুড়ি বের হয়ে যায়। তাঁকে ইন্দ্রভুষণের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সে সময় আবুরখীলে আত্মগোপনে ছিলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালের ডা. রেনুকা বড়–য়া, তাকে রাত্রে নিয়ে আসা হয়। শুধুমাত্র রক্তের অভাবে শেষ রাতে মারা যান মুক্তিযোদ্ধা মান্নান।
মদুনাঘাট অপারেশন সম্পর্কে মেজর রফিকুল ইসলাম লিখেছেন-
“১১ সেপ্টেম্বর ফ্লাইট লে. সুলতান বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল গেরিলা ও নিয়মিত সৈন্য নিয়ে এই অভিযানের জন্য হরিণা ক্যাম্প ছেড়ে রওনা হয়। ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে কাপ্তাই রোডে মদনঘাটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সুলতান তার গেরিলাদের নিয়ে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সেখানকার ট্রান্সফরমার’টি উড়িয়ে দেয়। গেরিলা দলটি কাপ্তাই এবং চট্টগ্রামের মাঝে অনেকগুলো বিদ্যুৎ-পাইলনও ধ্বংস করে ফেলে। এই অভিযানগুলোর ফলে কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়ে পড়ে। মদুনঘাটের বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনটি উঁচু দেয়াল এবং কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত ছিল এবং ১০ জন নিয়মিত পাকিস্তানি সৈন্য ও ২০ জন প্যারামিলিটারি মিলিয়ে প্রায় এক প্লাটুন সৈন্য সাব-স্টেশনটি পাহারা দিচ্ছিল। মাত্র মাসখানেক আগে আগস্টের ‘অপারেশন জ্যাক্পটে’ চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার পর চট্টগ্রাম শহরের এত কাছে সুরক্ষিত একটি অবস্থানে পাকিস্তানিদের উপর আমাদের এ ধরনের সফল অভিযান পরিচালনায় পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণরূপে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে যে, গেরিলারা এক বিরাট শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং গেরিলা-যুদ্ধকে কোনোমতেই আর হালকাভাবে নেয়া যাবে না। মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব্স্টেশন অভিযানে ইপিআর-এর এন.সি.ও. মান্নান অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে এবং অভিযান চলা অবস্থায় গুরুতররূপে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।”-রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম : লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, পৃ.২৯১ (ষষ্ঠ অনন্যা প্রকাশ, ঢাকা ২০০৬)।
রুমুর যত কথা
ফেরদৌস হাফিজ খান রুমুর জন্ম রাউজান উপজেলার কাগতিয়া গ্রামের একটি আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বায়ান্ন সালের জুলাই মাসের পয়লা তারিখে জননী রাশেদা খানমের কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হন রুমু। তাঁর পিতা একেএম হাফিজুর রহমান বিখ্যাত লোক। চট্টগ্রামের সোনালী অতীতের একজন ফুটবলার তিনি। কালু সিং যখন চট্টগ্রামের ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াতেন, তাঁদের সঙ্গেই বল নিয়ে মাঠে দৌড়াতেন হাফিজ সাহেব। কর্মজীবনে তিনি রেজিস্ট্রেশন বিভাগের চাকুরে ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৭ বছর বয়সে দেশকে বাঁচানোর কঠিন শপথ বুকে লালন করে বাবার কথা উপেক্ষা করেই রুমু পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। দু’মাসের ট্রেনিং সম্পন্ন করে ফিরে অংশ নিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ছাত্রাবস্থা থেকেই জড়িত ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। শওকত হাফিজ খান রুশ্নি একসাথে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাক এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। এই ডাক শুনেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। এরপর ২৬ মার্চ গণহত্যার পর নিজের গ্রাম বিনাজুরী কাগতিয়া হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতে চলে যাই। ভারতে প্রথমে হরিয়ানা, উদয়পুর হয়ে আগরতলা যায়।
স্কুলে অধ্যয়নকালে রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয়ে যায় রুমুর। ৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় তিনি স্কুলের শেষ ক্লাশের ছাত্র। বড় ভাই শওকত হাফিজ খান রুশ্নি তাঁর রাজনীতিতে আগমনের হেতু। তিনি ষাটের দশকের চট্টগ্রামের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বিশেষ করে কবিতায় তাঁর শক্তিমত্তা ও প্রতিভার প্রকৃষ্ট প্রকাশ ঘটেছিলো। তবে তখন ছিলো বাঙালি জাতির জাগরণের কাল। ৬ দফার ভিত্তিতে বাঙালির স্বাধিকারের দাবি স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে রূপ নিয়েছিলো। এক পাকিস্তান রাষ্ট্রে দুই রাষ্ট্র দুই জাতি সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন, এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রেও এমন দ্বিমুখী নীতি, বাঙালির প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যের নীতি অনুসরণ করা হয়েছিলো যে, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফায় পাঞ্জাবি-বাঙালি যে দুই জাতি তা বেশ স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেখা হয়েছিলো। ৬ দফায় এমন বার্তা নিহিত ছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছিলো। সুতরাং পাকিস্তানকে ফেডারেল স্টেট করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার জবাব দিয়েছিলো। ফলে বাঙালি জাতিসত্তা দানা বেঁধে উঠতে থাকলো। বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করলো। এই নতুন জাতীয় চেতনা থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা জেগে উঠেছিলো এবং ৬ দফা বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে পরিগণিত হয়ে দুর্বার আন্দোলনের জন্ম দিলো। রুশ্নি ভাই জাগ্রত বাঙালির জাগরণের কবি এবং বাগ্মী হয়ে চট্টগ্রামে রক্ত, আগুনের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিলেন। অনুজ রুমুর চোখে তিনি এক বিপ্লরের স্বাপ্নিক, রাজনীতির কবি ও আইকন। বলতে গেলে হাফেজ মিয়ার ঘাটফরহাদাবেগের গোটা বাড়িটি ৬ দফা আন্দোলন ও আওয়ামী রাজনীতির দুর্গে পরিণত হয়েছিলো।
১৯৬৯-৭১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে রুমু আরো বেশি রাজনীততে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় তাঁর বড় ভাই শওকত হাফিজ খান রুশ্নি একজন নামকরা রাজনীতিবিদ, কবি ও কলামিস্ট হিসেবে চট্টগ্রামে ও ঢাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনতার সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রথম শাহাদাত বরণ করেন দীপক, জাফর (ফুইক্যা) ও বশরুজ্জামান চৌধুরী। ২৮ মার্চ তারা শহীদ হন। সেদিন যে গাড়িতে তারা শহীদ হন, সে গাড়িতে তাঁরও থাকার কথা ছিলো। ফুইক্যা জাফর ও দীপক ছিলেন রুমুর স্কুল জীবনের বন্ধু। তারা একসাথে মিউনিসিপাল মডেল স্কুলে পড়তেন। তারা রুমুকে আন্দরকিল্লায় গাড়িতে ওঠানোর জন্য টানাটানি করেছিল। ওই গাড়িতেই তারা শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হন।
চট্টগ্রাম শহরে যখন পাঞ্জাবী ও বিহারীরা তা-ব চালাতে শুরু করে তখন রুমু ও ওমর ফারুক (পরে শহীদ হয়েছিলো) একটা পিকআপে করে শত শত হিন্দু ও মুসলমান পরিবারকে যারা যেখানে যেতে চেয়েছিলো শহর থেকে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শহরের পতন ঘটলে রুমু পরিবারকে নিয়ে মদুনাঘাট হয়ে সাম্পানে করে বাড়ি (কাগতিয়া-রাউজান) চলে গিয়েছিলেন।
তাঁর বড় ভাই রুশ্নি তখন পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হয়ে তাদের দলবল নিয়ে রামগড় চলে যান। রুমু কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। বিনাজুরী, আঁধারমানিক ও তার আশে-পাশে ফকা চৌধুরী ও তার ছেলের (সাকা চৌধুরীর) নির্দেশে, তার মুসলিম লীগ ও জামায়াতের অনুসারীরা লুটরতরাজ আরম্ভ করে। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে, গ্রামের চাষা-ভুষাদের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য করে। ঐ সময়ের মধ্যে রাউজানে প্রায় গ্রামগুলির লোকজন (হিন্দুরা) ভারতে চলে যেতে থাকে। তারপর আসে গ্রামের যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিল-কি হিন্দু, কি মুসলিম তাদের উপর হামলা। ফকার লোকজন রুমুদের বাড়িতে কয়েকবার তার বাবা হাফিজুর রহমান ও তার খোঁজ নেয় করে এবং তাদেরকে পেলে ধরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ছিল ফকা চৌধুরীর। উল্লেখ্য তারা যখন গ্রামের বাড়িতে ছিলেন, তখন শহরে ঘাটফরহাদবেগের বাসায় কয়েকবার সাকার চেলা “খোকা” দলবল নিয়ে হামলা করে। তাদেরকে না পেয়ে তারা তার এক চাচা নুরুল হুদাকে ফকা চৌধুরীর পাহাড়ে নিয়ে যায় এবং অত্যাচার করে। তারা তাঁর কাছ থেকে হাফেজ মিয়া, রুশ্নি ও রুমু কোথায় আছে জানতে চেয়েছিলো। তাঁর কাছ থেকে কোন তথ্য না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
দিনের পর দিন ফকা’র লোকদের এসব অত্যাচার, জোর জবরদস্তি দেখতে দেখতে রুমুর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তাঁর ভিতরের স্বদেশপ্রেম ও মানবিকতা জেগে ওঠে এবং তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে দেশ স্বাধীন করার সাহস ও দৃঢ় সংকল্পে উদ্বুদ্ধ করে।
এভাবে কিছুদিন থেকে তার আব্বাকে অনেক বুঝিয়ে মরহুম খায়রুল আনোয়ার ও মোজাম্মেল হক সহ ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন রুমু। প্রথমে রোসাংগিরি যান। তাঁর বাবা কিছুতেই রুমুকে ভারতে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ তাঁর ছিলো দুই ছেলেকে হারানোর ভয়। প্রথম ছেলে রুশ্নি তো ইতিমধ্যে চলে গেছে। তাই রুমুকে তিনি চোখে চোখে রেখেছিলেন।
রোসাংগিরি যে বাড়িতে তারা অবস্থান করেছিলেন সেটা তাদের এক নিকটাত্মীয়ের বাড়ি। সেখানে তার সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল তার দুলাভাই হানিফ সাহেবের (তার মামাত বোন মরহুম অধ্যক্ষ রওশন আখতার হানিফের স্বামী)। রুমু যখন ভারতে যাওয়ার জন্য ভীষণ জেদ তখন নিরুপায় হয়ে তার বাবা একশর্তে রাজি হয়েছিলেন যে, রুমুর সঙ্গে তার দুলাভাইকেও ভারতে যেতে হবে। কিন্তু ওখানে গিয়ে যে কারণেই হোক হানিফ সাহেবের ভারত যাত্রা বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিলো যে রুমুরও আর ভারত যাওয়া হবে না।
কিন্তু রুমু তখন বেপরোয়া। রোসাংগিরি থেকে পালিয়ে তিনি নানুপুরে মির্জা আবুর বাড়িতে যান। তার ছেলে মির্জা আকবর ছিলেন তার বন্ধু, সেখানে ২/৩ দিন লুকিয়ে ছিলেন। ওদিকে তাঁর বাবার পীড়াপীড়িতে তাঁর মামাতো ভাই খসরু (মামা বাদশা মিয়া চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র) আরও কয়েকজনকে নিয়ে তাকে ফেরত আনার জন্য মির্জা আবুর বাড়িতে যান। কিন্তু রুমু তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া হয়ে ছিলো। তাঁরা কিছুতেই রুমুকে বাড়ি ফিরে আসতে রাজি করাতে পারলেন না। ফলে তারা ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে ফেরত আসলেন। রুমু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য অন্যান্য শরণার্থীদের সাথে রামগড় হয়ে প্রথমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম প্রবেশ করেন। তারপর ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণা এবং উদয়পুর হয়ে প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার আগরতলা যান।
আগরতলা এনপিসিসি রেস্ট হাউস-এ থাকতেন শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী এমপিএ, তাঁর সঙ্গে থাকতেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী। সেখানে চট্টগ্রামের বিখ্যাত ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হাটহাজারীর মো. ইদ্রিস ও সিটি কলেজের ছাত্রনেতা হাজি কামাল, গহিরার কাজী আবদুল ওহাব সহ অনেকে অবস্থান করছিলেন। এনপিসিসি রেস্ট হাউস-এ প্রায় ৭ দিন অবস্থান করার পর একদিন তাকে জনাব ইদ্রিস বললেন, তুমি আমার জায়গায় সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং-এ যাও। রুমু জানতেন না সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং কি, সেই প্রথম শুনলেন। তবে তিনি দেখতেন ইদ্রিস সাহেবরা কোথাও ট্রেনিং যাওয়ার জন্য ১ সপ্তাহ ধরে প্রত্যেকদিন সকালে বের হতো, বিকেলে চলে আসত। ট্রেনিং-এ যাওয়ার জন্য হয় ঋষরমযঃ নেই হয়তো ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃ নেই। সেটাই সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং। তিনি আরো জানতে পারলেন যে ট্রেনিং-এ তারা যাচ্ছেন, সেটা হবে কর্নেল ওসমানির একটা নিজস্ব বাহিনী। এই স্পেশাল ট্রেনিং -এর জন্য সারা বাংলাদেশ থেকে ১১০ জনকে নির্বাচন করা হয়েছে। ইদ্রিস সাহেব জহুর আহমদ চৌধুরীর সাথে দেখা করে তাঁকে বললেন তাঁর যেতে অসুবিধা আছে। তাঁকে অনুরোধ করলেন তাঁর জায়গায় তিনি যেন রুমুকে ঢুকিয়ে দেন। জহুর আহমদ চৌধুরী স্পেশাল ট্রেনিং-এর জন্য রুমুর নাম দিলেন, এভাবে রুমু সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং-এ অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন।
পূর্বকথা
রুমুদের ট্রেনিং হয় বিহারের চাকুলিয়ায় একটা পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টে। ট্রেনিং শেষে রুমু ও হাজি কামাল হরিণায় চলে আসেন। তখন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিক, তাঁর ডেপুটি ছিলেন ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরী, এছাড়া আরো অনেকের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের সঙ্গেও দেখা হয় রুমুদের। অতঃপর দায়িত্ব বল্টন; রুমুকে রাউজান আর হাজি কামালকে হাটহাজারীর দায়িত্ব দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রুমু রাউজান এসে বিএলএফ প্রধান শহীদ নাজিম, কাস্টমস অফিসার (অব.) মারুফ শাহ চৌধুরী, বর্তমানে দৈনিক পূর্বকোণের চিফ রিপোর্টার নওশের আলী খাঁন, সিরাজদ্দৌলা খাঁন, বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল আলম খান, আকতার মিয়া, কামাল মিয়া, গহিরায় প্রাক্তন চেয়ারম্যান এদের দেখতে পান এবং তাদের সাথে পরিচিত হন। তার সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিল তোফায়েল, আহসান উল্লাহ, ইউসুফ খান, নওশের আলী খাঁন, মোর্শেদ, কিরণলাল আচার্য, এলএমজি হাসেম, শফি, ফিরোজ, বিমলেন্দু রায়, যীশু বড়–য়া, এয়ার মোহাম্মদ, মাহবুব হাসেম, মোজাহের হারুন, ইসমাইল এবং আরো অনেকে। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তারা হলেন জমির চৌধুরী, ইদ্রিস চৌধুরী, ফজলুল হক, ডোমখালির চেয়ারম্যান বেবী বড়–য়া, আবুরখীলের মেম্বার যতীন্দ্র, গহিরার আকতার মিয়া। তাঁদের শেল্টার থেকে তারা রাউজানে বিভিন্ন জায়গায় রাজাকার ও পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতেন। এর মধ্যে রাউজানে পথের হাট, কালু পাড়ার টেক, কাগতিয়ার হাটে অপারেশন চালানো হয় এবং রাউজানকে তারা প্রায় মুক্ত এলাকায় পরিণত করে ফেলেন। জোন হিসেবে রাখা হয়। সেসময় রাউজান, রাঙামাটি রোড, মদুনাঘাট, কাপ্তাই রোড ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে।
স্বাধীনতা এবং রুমু
স্বাধীনতার পর ৭৭ সাল পর্যন্ত রুমু দেশে ছিলেন। তারপর তিনি ইরান হয়ে জার্মানি চলে যান। সেখানে তিনি সোশ্যাল সায়েন্সের ওপর জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয় এমএ ডিগ্রি নেন। ১৯৮০ সালে তিনি জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুবাদক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ৫টি ভাষায় দোভাষীর কাজ করতেন। এই পাঁচটি ভাষা হলো-বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ও জার্মান। ঐসময় জার্মানিতে শরণার্থীর ঢল নেমেছিলো। ১৯৮০-১৯৯৫ মেয়াদে রুমু জার্মানির সমস্ত আদালতে অনুবাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে তিনি আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ২০০১-২০১৩ মেয়াদে রুমু রিফিউজি ক্যাম্পে ইনচার্জ ছিলেন। এ সময় ২৮টি দেশ থেকে রিফিউজি এসে জার্মানি সয়লাব করে ফেলেছিলো। রুমু তাঁর জার্মান সহপাঠিকে বিয়ে করেন। তাঁর নাম পেট্রা হাফিজ খান। তাঁদের একমাত্র কন্যা অনীশা হাফিজ খান রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইংরেজি ও জার্মান সাহিত্য-এ তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি নিয়ে বার্লিনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। রুমু একটি ডিকশানারি লিখেছেন। এটি বাংলা-জার্মান-ইংরেজি-জার্মান ডিকশানারি।
সি-ইন-সি স্পেশাল
সি-ইন-সি স্পেশাল কোনো আলাদা বাহিনী নয়। কিন্তু এমন একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে, মুক্তিযুদ্ধে সি-ইন-সি স্পেশাল নামে একটি স্বতন্ত্র ফোর্স ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ সময়ে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর ইচ্ছায় একটা বিশেষ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। এই ট্রেনিং যারা নিয়েছিলেন, তাদেরকে নিয়েই বিভ্রান্তির উৎপত্তি। তারা নিজেরা যেমন আলাদা ফোর্স ভাবা শুরু করেছিলেন তেমনি সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাও ভাবতে শুরু করেছিলেন সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং প্রাপ্তরা হয়তো আসলে আসলে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী। কিন্তু যাঁর নামে এই কথিত ফোর্স’র পরিচয়, সেই কমান্ডার-ইন-চিফ অর্থাৎ কর্ণেল ওসমানী কিন্তু এই ধারণা বাতিল করে দিয়ে বলেছেনÑ“আসলে সি-ইন-সি স্পেশাল ফোর্স নামে কোন স্বতন্ত্র বাহিনী ছিলো না।”
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “শুরুতে গেরিলাদের দু’সপ্তাহ ট্রেনিং দেয়া হতো। কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিল না। পরে মেয়াদ খানিকটা বাড়ানো হলো। তখন তিন সপ্তাহের মতো সাধারণ গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হতো। এছাড়া আমি কিছুসংখ্যক গেরিলার জন্যে একটি বিশেষ কোর্সের বন্দোবস্ত করেছিলাম। একে বলা হতো স্পেশাল কোর্স। ওটা ছয় সপ্তাহের ছিল। এই কোর্সে গেরিলা লিডারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এবং আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার অর্থাৎ শহরাঞ্চলে আবাসিক এলাকায় যুদ্ধ করার পদ্ধতিও তাদের শেখানো হতো। এদের ভূমিকা ছিল গেরিলাদের নায়কত্ব করা এবং সাধারণ গেরিলাদের দিয়ে সম্ভব নয় এমন সব কাজ সম্পন্ন করা। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল খুব কম। চাকুলিয়া নামে এক জায়গায় তাদের ট্রেনিং দেয়া হতো। এসব গেরিলারা বিশেষভাবে সিলেট হয়ে যেতো এবং এদের সিলেকশনের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমি লোক নিয়োগ করেছিলাম। তাই এদের নাম কেউ কেউ বলতো সি-ইন-সি স্পেশাল। আসলে এ নামে কোন স্বতন্ত্র বাহিনী ছিল না।”
আমাদের চট্টগ্রাম থেকে সাতজন চাকুলিয়ায় স্পেশাল ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন-জাফর আহমদ ও এমএ মাহফুজুুল আলম জাহেদী (মিরসরাই), এসএম কামালউদ্দিন (হাজি কামাল-হাটহাজারী), এমএ হালিম (ফটিকছড়ি), ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু (রাউজান), জাহাঙ্গীর চৌধুরী (কদমতলী) ও সাইফুল আলম (চন্দনপুরা)।