বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্রাভেল টিউবার সাংবাদিক দম্পতির ভ্রমণনেশা

প্রকাশিত : ৬:২১ অপরাহ্ন বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

‘ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র। গুস্তাভ ফ্লুবেয়ারের এই কালজয়ী উক্তির সাক্ষী আমাদের চাটাগাঁ শহরের এক সাংবাদিক দম্পতি। তাঁদের সাথে দেখা হলে লোকে জিজ্ঞেস করে – বেড়াতে যাচ্ছেন? নাকি বেড়ানো শেষে ফিরলেন? কিংবা ফেসবুক বা ইউটিউবের কমেন্ট বক্সে অনেকেই জানতে চান – পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য কোথায় ?

উত্তরটা শুনি তাঁদের মুখেই। বাংলাদেশ, ভারত ঘুরে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার পথে-প্রান্তরে পদচিহ্ন রেখে এসেছেন এই দম্পতি। অসম্ভব বিনয়ী ও নিরহংকারী মানুষ দু’টির ভ্রমণ সাথী তাঁদের শিশুকন্যা মেলিনা। মাতৃভূমির বাইরে দেশবিদেশ ঘুরেটুরে শেষপর্যন্ত নিজেদের তাঁরা পৃথিবীর সন্তান ভাবতেই ভালোবসেন। মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের একথা সত্য যে “যিনি অপ্রবাসী, তাঁরাই সবচেয়ে সুখী”! আর তাঁদের ভ্রমণব্লগ এবং ইউটিউব বলছে, এক ঝাঁক বালি হাঁসের মতো ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি উড়ে এসে তক্ষুনি কাতর করে দিতে পারে আপনাকে। স্মৃতির উত্তাপে হাতছানি দিয়ে ডাকবে আপনাকে। তাঁরা দুজনেই চট্টগ্রামের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে কাজ করেন। ট্রাভেল টিউবার ও সাংবাদিক জিয়াউল হক বলেন, ‘মানুষ হিসাবে আমি বাউন্ডুলে, বোহেমিয়ান! আমার এমন ভবঘুরে জীবন নিয়ে আমার বাবা-মা বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। তাদের চিন্তার মূল কারণ ছিল আয় রোজগারের টাকা সঞ্চয় না করে দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে সব নষ্ট করছি। শেষ বয়সে বাবা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার ব্যাপারে। বাড়ির বড়রা একসময় ভাবলেন বিয়েশাদী করলে হয়তো ইতি ঘটবে আমার এই বোহেমিয়ান জীবনের। তাই ২০১৪ সালের শেষদিকে এসে আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলো মেলিসা মিথিলা। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভাবলেন এই বুঝি পায়ে শিকল পড়লো’। থামলেন জিয়া, একটু বাঁক নিয়ে বলে গেলেন- ‘কিন্তু বিধি বাম। বিয়ের পরদিন ভোরেই কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম দু’জনে। সেবার কলকাতা এবং ব্যাংকক হয়ে ঘরে ফিরেছিলাম ৮ দিন পর। সবার স্বপ্ন ভঙ্গ করে তারপর থেকে ফি বছর নবউদ্যমে চলতে থাকে আমাদের যৌথ ভ্রমণ। ২০১৭ সালের একদম শেষের দিকে আমাদের কোলজুড়ে আসে ছোট্ট মেলিনা। সে সহ এখন আমাদের ৩ জনের ছোট্ট একটি বাউন্ডুলে পরিবার’।

এই কথাগুলো বলছেন চট্টগ্রামের একমাত্র ভ্রমণবিষয়ক ইউটিউবার জিয়াউল। আপনারা অনেকেই জানেন, বিডি ট্রাভেলার্স ( bd travellers ) নামে এই দম্পতির একটি ভ্রমণ বিষয়ক চ্যানেল আছে ইউটিউবে। তাদের ভ্রমণ ব্লগ গুলো পোস্ট করা হয় এই চ্যানেলে । তিনি বলেন, আমার বাউন্ডুলে জীবন শুরু হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে ঘর পালিয়ে। সে বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে হঠাৎ ১৫ দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই যে শুরু, আজ পর্যন্ত বাউন্ডুলেপনা আমার পিছু ছাড়ে নি। ১৯৯৫ সালে এসে প্রথমবার দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম প্রতিবেশী দেশ ভারতে। অবশ্য সেটা ছিল পড়াশোনার উদ্দেশ্যে । তারপর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অগুণিতবার যাওয়া আসা। ২০০৪ সাল থেকে ভারত ছাড়িয়ে যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। প্রথমে থাইল্যান্ড তারপর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেড়াতে শুরু করলাম বিভিন্ন দেশে । এই তালিকায় আছে মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চীন, হংকং, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ,সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুর্কি এবং সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র। এর বেশকিছু দেশে একাধিকবার সহ এযাবৎ বিদেশ ভ্রমণের গণনার হিসাব শতকের ঘর অতিক্রম করেছে।আজ পর্যন্ত তাদের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজারেরও বেশি। তার মতে, ঠিক দু’বছর আগে নিতান্ত শখের বশেই শুরু করেছিলাম ইউটিউবিং। যেটা এখন শখের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের কাছে । বাউন্ডুলেপনা করে এ জীবনে যা খরচ করেছি , ইউটিউব সেটা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। ব্লগিং শুরু করেছি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। প্রথম ভিডিওটি আপলোড হয় ১৬ সেপ্টেম্বর। কখনো ভাবিনি শখেরবশে আপলোড করা ভিডিওগুলো দিন দিন এতোটা পথ এগিয়ে আনবে আমাদেরকে। বাংলাদেশে অনেক ট্রাভেল ব্লগার আছেন। তাদের বেশিরভাগই সলো ট্রাভেলার। সে হিসাবে তারাই একমাত্র বাংলাদেশি ফ্যামিলি ট্রাভেল ব্লগার, যারা বাংলা ভাষায় ব্লগ করেন । সম্প্রতি তারা ইউটিউবের পক্ষ থেকে ক্রিয়েটর্স এওয়ার্ড হিসাবে সিলভার প্লে বাটন পেয়েছেন।

ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।’তাই হয়তো সেই গল্প গুলো তুলে ধরছেন জিয়াউল bd travellers এর মাধ্যমে । বিখ্যাত দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন বলেন- ‘পৃথিবী একটা বই আর যারা ভ্রমণ করে না তারা বইটি পড়তে পারে না’। জিয়া-মিথিলা দম্পতির ভ্রমণ স্রোতে গা ভাসালে আপনিও হয়ে উঠবেন একজন আদর্শ পরিব্রাজক। তাঁদের আছে এমন একটি বই, যে বইয়ের কোন পাতা স্পর্শ করা যায় না কিন্ত আনন্দ পাওয়া যায়, কিছু শেখা যায়, কিছু কথাও বলা যায়!সত্যজিতের আগন্তুক সিনেমায় অনীলার ছোটমামা মনমোহন মিত্র। ৩৫ বছর ধরে নিরুদ্দেশ। ঘুরছেন পৃথিবীর পথে, ঘর ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে। আগন্তুক হয়ে অগ্নিপরীক্ষার প্রতীক, বা মূর্তিমান প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে হাজির কলকাতায়। এই মনমোহন মিত্রই রাহুল সাংকৃত্যায়নের বাঙালি প্রতিরূপ। যিনি বলতেন, ‘ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন’। যতবার জিয়া-মিথিলা দম্পতির সান্নিধ্য পেয়েছি, ততবার ভ্রমণ করেছি তাঁদেরই সাথে যেন। বুঝেছি ভ্রমণ বিষয়ক তাঁদের কথাগুলির সত্যতা। ভ্রমণ যাকে পেয়ে বসেছে তাঁর পক্ষে এক জায়গায় বেশীদিন থাকা সম্ভব নয়। বাঙালির মনে মনে বাস করে একটি করে মনমোহন। সেই মনকে জাগাতে হয়। জিয়া-মিথিলার মতো পৃথিবীর পাঠশালার ঘণ্টাধ্বনি শোনো। চলো..জিয়া থেকে এক কাঠি সরেস মিথিলা। জীবন ও ভ্রমণসাথী জিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনিও বলেন, এই পৃথিবী কত সুন্দর। কত চমৎকার তার রূপরস। প্রিয় মানুষদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গেলে কত চমৎকার সময় কাটে আমাদের। অথচ পৃথিবীর সব সৌন্দর্য দেখার আগেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় আমাদের! সুতরাং সময় থাকতে থাকতে পৃথিবীকে আবিস্কার করুন। ভ্রমণ এক আদিম নেশা। এই নেশার মুক্তি নাই! চাকরি করে বেড়ানোর জন্য এতো সময় কিভাবে বের করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে আমরা বছরে ৪ থেকে ৫ বার বিদেশ ভ্রমণ করি। যে কয়দিন অফিসের বাইরে থাকি দেশে এসে সাপ্তাহিক ছুটি না কাটিয়ে সেগুলো পুষিয়ে দিই। তার মানে দেশে থাকাকালীন একদিনের জন্যও আমরা অফিস মিস করি না।হ্যাঁ, এই ইউটিউবার দম্পত্তির কাছে ভ্রমণ মানে হচ্ছে সংসারবোধটাকেও ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া! দু’টি ব্যাকপ্যাক আর শিশু ও মোবাইল-গিম্বলকে আপাতত সম্বল করা! কোন এক আলোকিত দিনে বিশ্বের কোনো একপ্রান্তে যাযাবরের মতো সংসার পাতা! এই তিনজনের কাছে ভ্রমণ মানে অবিরাম পথ চলা! যে পথ চলাতেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া এবং ভ্রমণ শেষে সবার মাঝে ইউটিউব আর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ ভাগ করা।

রাজীব নন্দী
শিক্ষক, ট্রাভেলার, ভিডিও ব্লগার

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র- Barta24.net

আরো পড়ুন